সংগৃহীত ছবি
                                    
২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় রাখার জন্য আওয়ামী লীগ প্রায় ১১ কোটি ভোটারের কাছে নতুন করে ভোট চাইবে। বরাবরের মতোই বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন বিশৃঙ্খল হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকার এবং তার নেতারা ক্ষমতা না ছাড়ার বিষয়ে অনড়।
ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং ১৩ বছরের নিরবচ্ছিন্ন শাসন- সবমিলিয়ে আওয়ামী লীগ খুব বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় রয়েছে এমন ধারণা সত্ত্বেও, প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ৭৮ বছর বয়সী নেত্রীর অসুস্থতা এবং ২০০৮ সাল থেকে লন্ডনে নির্বাসিত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানকে নিয়ে এক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন।
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক অনলাইন ব্লগ 'এশিয়া সেন্টিনেল' এ ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক নাভা ঠাকুরিয়া এমন মন্তব্য করে লিখেছেন, ২০২২ সালে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬.১৫ শতাংশ। এরপর তা বার্ষিক ৮.৬১ শতাংশ ক্লিপ-এ বেড়ে গেছে। জীবনযাত্রার এই সংকটের মধ্যে, হাজার হাজার বিএনপি সমর্থক এবং অন্যরা ৭৫ বছর বয়সী হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির দাবিতে রাস্তায় নেমেছে। ঢাকার প্রধান প্রধান মোড়গুলোতে অবরোধকারী-দাঙ্গাকারীদের ওপর পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করছে। প্রতিবেশী মিয়ানমারে জাতিগত সহিংসতার কারণে বাস্তুচ্যুত হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে এবং আইএমএফ -এর নির্দেশনায় সরকার চরম দারিদ্র্য অর্ধেকে কমিয়ে, নিম্ন মধ্যম আয়ের মর্যাদা অর্জন করার পরও; হাসিনা এখন যুক্তিযুক্তভাবে সবচেয়ে গুরুতর রাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি। যদিও জুলাই মাসের শেষের দিকে সহিংস বিক্ষোভের প্রকোপ কমে গেছে, তবে মনে হচ্ছে আগামী সপ্তাহগুলোতে তা আরো বাড়বে। গত এক দশকে, বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য পশ্চিমা উন্নয়ন প্রেসক্রিপশন অনুসরণ করে, বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে।
দেশটি তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার জন্য প্রশংসা কুড়িয়েছে। আনুষ্ঠানিক কর্মশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ স্বাধীনতার সময় যেখানে ছিল ৪ শতাংশ, সেটি এখন বেড়ে ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। মূলত দেশটির সমৃদ্ধ পোশাক রপ্তানি শিল্পের কারণেই এটা হয়েছে।
দেশটিতে উগ্র ইসলামি গোষ্ঠীর হুমকি কমে গেছে বলে মনে হচ্ছে। এতসব সত্ত্বেও, দেশটিতে রাজনীতি এবং নাগরিক অধিকারের পরিবেশ সীমাবদ্ধ। নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, নিরাপত্তা বাহিনীগুলো নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং জোরপূর্বক গুম সহ গুরুতর অপরাধের সাথে জড়িত।
র্যাবের উপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার উদাহরণ টেনে নাভা মানবাধিকার সংগঠনের বরাতে লিখেছেন, সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে সাংবাদিক ও সমালোচকদের গ্রেপ্তার করেছে, সুশীল সমাজকে দমিয়ে রেখেছে। অতীত অভিজ্ঞতার কারণে সরকার নির্বাচনে কারচুপি করতে চাইবে বলে আশঙ্কা করার যৌক্তিক কারণ থাকায় বিএনপি নেতারা আসন্ন নির্বাচন পরিচালনার জন্য নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসনের দাবিতে অটল রয়েছেন।
বিরোধী জোট বিশ্বাস করে, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং স্থানীয়ভাবে দুর্নীতিতে বিপর্যস্ত ক্ষমতাসীন জোট অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে হেরে যাবে। বিরোধী নেতারা নির্বাচনে অংশ নিতে সম্মত হচ্ছেন না, যতোক্ষণ হাসিনা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার তত্ত্বাবধানে একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সমর্থন করছেন। যেটা অসম্ভাব্য বলেই মনে হচ্ছে। অন্যথায়, তারা (বিরোধীরা) অতীতের মতো জাতীয় নির্বাচন বয়কট করতে পারে। কিন্তু, বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘকালীন নারী সরকার প্রধান হাসিনা নির্বাচনের আগে পদত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তার যুক্তি- এটি সংবিধান অনুযায়ী বাধ্যতামূলক নয়।
বিএনপি এবং তার সহযোগীরা, বিশেষ করে জামায়াত-ই-ইসলামী এবং অন্যান্য ইসলামপন্থী দলগুলো, সামনের দিনগুলোতে সারা দেশে আরও বেশি করে রাস্তায় বিক্ষোভ করতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। অনেক বিক্ষোভকারী সম্ভবত জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়ার আকর্ষণ কাড়তে সহিংস পথ বেছে নেবে। বিরোধী জোট বর্জন করলে নির্বাচনের পরও এই কোন্দল অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। বিপদের কারণ এটা যে, তীব্র এবং নিরবচ্ছিন্ন রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলায় 'উর্দি পরা মানুষদের' পা রাখার জন্য আমন্ত্রণ জানানোর ঝুঁকি থাকে যার ফলে নতুন আরেক শক্তিশালী ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে, যেমনটি অতীতে ঘটেছে। সামরিক হস্তক্ষেপের ইতিহাস রয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে।
বিরোধীরা নির্বাচনের বাইরে থাকায় আওয়ামী লীগ জোট ২০১৮ সালের নির্বাচনে ২৫০টিরও বেশি সংসদীয় আসন জিতেছে এবং ৩৫০ সদস্যের জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ভোগ করছে। হাসিনা একজন প্রভাবশালী নেতা হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছেন এবং সম্প্রতি জি-২০ সম্মেলনে যোগদানের জন্য নয়াদিল্লি থেকে বিশেষ আমন্ত্রণের পর আরও বেশি রাজনৈতিক সুবিধা পেয়েছেন। তিনিই একমাত্র দক্ষিণ এশীয় সরকার প্রধান যিনি ওই অনুষ্ঠানে অংশ নেন এবং আয়োজক ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করেন।
বছরের পর বছর ধরে, আমেরিকান সরকার এবং অন্যান্য অনেক পশ্চিমা দেশ হাসিনাকে স্বচ্ছ নির্বাচন আয়োজনের জন্য বারবার আহ্বান জানিয়েছে যাতে সব বিরোধী দল অংশগ্রহণ করতে পারে এবং ভোটাররা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কূটনীতিকরা বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা নির্বাচন পর্যবেক্ষক পাঠানোর পরিকল্পনা করছেন, যদিও আওয়ামী লীগ সরকার যুক্তি দিয়েছে যে তাদের নির্বাচন কমিশন সততার সাথে ও স্বাধীনভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে যথেষ্ট সক্ষম।
আগের দুটি নির্বাচনে বৈধতার অভাব ছিল- নোবেল বিজয়ী, নির্বাচিত কর্মকর্তাবৃন্দ, ব্যবসায়িক ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ সহ ১৭৫ জনেরও বেশি বিশ্বনেতা এমন একটি বিবৃতি জারি করার পর হাসিনা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার জন্য তাদের আন্তর্জাতিক নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের পাঠানোর পরামর্শ দেন। বাস্তবে, ১৯৯০-৯১ সালে সামরিক শাসকদের খপ্পর থেকে বাংলাদেশ সংসদীয় গণতন্ত্রে রূপান্তরিত হওয়ার পর নির্বাচনগুলোতে সাধারণত ব্যাপক বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতা দেখা গেছে। বিএনপি ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে কারচুপির চেষ্টা করলেও ব্যাপক জনবিক্ষোভের কাছে তাকে হার মানতে হয়েছিল। নির্বাচনী বিশৃঙ্খলার কারণে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা জন্মলাভ করে যেটিকে হাসিনা উপেক্ষা করছেন বলেই মনে হচ্ছে।
তাছাড়া অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে হাসিনার প্রতিহিংসাপরায়ণতা রয়েছে। ক্ষুদ্রঋণের মডেলে দরিদ্রদের জীবনমান উন্নয়নের মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষের জীবন বদলে দিয়ে তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। এক খোলা চিঠিতে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন, বারাক ওবামা এবং হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটন (যথাক্রমে সাবেক আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী); শিরিন এবাদি, ওরহান পামুক (তুরস্কের নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক) সহ ১০০ জন নোবেলজয়ী এবং ইনফোসিসের প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ মূর্তি (বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের শ্বশুর) এবং অন্যান্যরা ইউনূসের বিরুদ্ধে আইনি কার্যক্রম স্থগিত করতে হাসিনার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি সম্পর্কে মন্তব্য করে তারা মানবাধিকার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অবনতিশীল পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
সম্প্রতি জল্পনা শুরু হয়েছে যে, সম্মিলিত বিরোধী দলগুলো আগামী জানুয়ারির নির্বাচনে ইউনূসকে তাদের নেতা হিসেবে সামনে আনতে পারে। এটা অসম্ভাব্য বলেই মনে হচ্ছে। ২০০৭ সালে, ইউনূস নাগরিক শক্তি (জনগণের শক্তি) নামে একটি দল শুরু করার ধারণা নিয়ে এগুলেও তিনি শিগগিরই উক্ত ধারণাটি ত্যাগ করেন। তিনি দলীয় রাজনীতিতে যোগ দেবেন না বলেও জানিয়ে দেন। যাই হোক, বাতিল করা ওই পদক্ষেপ হাসিনার কাছ থেকে বৈরিতা অর্জন করে। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় ফিরে আসার পরপরই, হাসিনা তার বিরুদ্ধে একাধিক তদন্ত শুরু করেন। পরে তার বিরুদ্ধে (আইন) লঙ্ঘনের অনেক অভিযোগ আনা হয় যেগুলো সরকার সৃষ্ট বলেই ধারণা করা হয়। রাজনীতিতে ফেরার কোনো ইচ্ছা নেই বলে তার বক্তব্যগুলোর পাশাপাশি হাসিনার ক্রমাগত আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে, মনে হচ্ছে না যে তিনি নিজের সিদ্ধান্ত বদলাবেন।
            
                                                        
                                                        
                                                        
                                                        
                                                        
                                                        
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: