সংগৃহীত ছবি
                                    রাজধানীর উত্তরার বাসিন্দা হাসিবুল ইসলাম তার দুই সন্তান ও স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে সোমবার সকাল সাড়ে ৭টায় আগারগাঁও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার মাঠে ঈদের নামাজ আদায় করতে আসেন। নামাজের সময় যত এগিয়ে আসছিল, তিনি ঈদের জামায়াতে মানুষের বিপুল উপস্থিতি দেখে বিস্মিত হচ্ছিলেন। সকাল সাড়ে ৮টায় নামাজ শেষে পুরো পরিবার নিয়ে ঈদ আনন্দ মিছিলে যোগ দেন। মিছিলে তার ৮ ও ৬ বছরের দুই শিশু নেচে নেচে ঈদের স্লোগান দিচ্ছিল এবং পুরো আয়োজন উপভোগ করছিল।
এমন ঈদ আয়োজনে অংশ নিতে আসা হাসিবুল ইসলাম বলেন, গ্রামের ঈদের আনন্দ না পাওয়ার দুঃখ ভুলে গেছেন। শিশুরাও রঙিন আয়োজনের আনন্দে মেতে ওঠে।
হাসিবুল ইসলাম আরও বলেন, 'আমি আমার জীবনে এমন ঈদ আয়োজন দেখিনি। শুনেছি, মুঘল আমলে এমন ঈদ আনন্দ মিছিল হতো। আজ মুঘল আমলের সাজে ঈদ উদযাপনে শামিল হয়ে মনে হচ্ছে, বাঙালির সেই ঐতিহ্যের দিনগুলোতে ফিরে গেছি।'
তিনি বলেন, 'আগে ঈদ মানেই ছিল সকালে নামাজ শেষে বাসায় গিয়ে খাওয়া, তারপর বিকেলে বাচ্চাদের নিয়ে চিড়িয়াখানায় ঘুরতে যাওয়া। কিন্তু এবার এত মানুষের সমাগমে শিশুরাও প্রাণ ভরে আনন্দ করছে। বিশেষ করে তারা ঘোড়া, মহিষের গাড়ি আর নানা রঙের সাজ দেখে খুবই উচ্ছ্বসিত। আমরা চাই, প্রতি বছর এমন আয়োজন হোক। উৎসবগুলো যেন সত্যিকারের উৎসবের মতো উদযাপন করা যায়।'
হাসিবুল আরও বলেন, 'বিগত ফ্যাসিবাদী শাসনামলে নানা অজুহাতে আমাদের ধর্মীয় উৎসবগুলো ঠিকভাবে পালন করতে দেওয়া হতো না। এবার বুকভরে নিরাপত্তার সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে পারছি।'
হাসিবুলের ছোট সন্তান হামজা বলে, 'এবারের ঈদে খুব আনন্দ হচ্ছে। আজকে আব্বু-আম্মুর সঙ্গে সারাদিন ঘুরব আর মজা করব।'
শুধু হাসিবুল ইসলাম নন, আগারগাঁওয়ে ঈদের নামাজ শেষে ঈদ আনন্দ মিছিলে যোগ দেন হাজার হাজার মানুষ। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এসে এ আয়োজনে অংশ নেন। নানা শ্রেণি-পেশা ও বয়সের মানুষ জানান, ঢাকায় এমন আয়োজন তারা আগে কখনও দেখেননি।
এবারই প্রথম আগারগাঁওয়ের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার মাঠে ঈদের জামায়াত আয়োজন করা হয়। আয়োজক সংস্থা ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) এত মানুষের অংশগ্রহণের বিষয়টি কল্পনাও করেনি। নামাজের জন্য নির্ধারিত প্যান্ডেলের তুলনায় ৩-৪ গুণ বেশি জায়গায় মানুষের সমাগম ঘটে।
নামাজ শেষে সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে শুরু হয় ঈদ আনন্দ মিছিল, যা বেগম রোকেয়া সরণি হয়ে খামারবাড়ি ঘুরে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে শেষ হয়। সেখানে আয়োজন করা হয় এক বিশাল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের।
এছাড়া, আগারগাঁও চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে ২০০টিরও বেশি স্টল নিয়ে বসেছে ঈদ মেলা। এতে খাবার, পোশাক, প্রসাধনীসহ নানা ধরনের পণ্যের স্টল রয়েছে। মেলা চলবে মঙ্গলবার পর্যন্ত।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শিল্পীরা 'ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ...' গানটি গাওয়া শুরু করতেই হাজারো মানুষের কণ্ঠে মুখরিত হয়ে ওঠে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ। সবাই প্রাণ খুলে গান গেয়ে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করেন।
ঈদের আয়োজনে অংশ নেওয়া সুমাইয়া বেগম টিবিএসকে বলেন, 'এই আয়োজনের কথা দুদিন আগে শুনেই বন্ধুরা মিলে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। তাই সকাল থেকেই আছি। পুরো রাস্তা জুড়ে ঈদের স্লোগান দিয়েছি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান গেয়েছি। মনে হচ্ছে, জীবনে প্রথমবার প্রাণবন্ত ঈদ উদযাপন করছি।'
অনুষ্ঠানে আসা সনাতন ধর্মাবলম্বী কণিকা রাণী বলেন, 'বাচ্চাদের নিয়ে ঈদ আনন্দ মিছিলে এসেছি। উৎসবে এমন আয়োজন হলে ধর্মীয় কোনো ভেদাভেদ দেখি না। বরং আমরা শাঁখা-সিঁদুর পরে এলেও মুসলিমরা আমাদের উৎসাহ দিয়েছেন। এমন বাংলাদেশই সবাই দেখতে চায়। আমরা কোনো ধরনের শঙ্কা অনুভব করছি না।'
আগারগাঁও মেলা প্রাঙ্গণে উচ্ছ্বসিত শিশুরা
আগারগাঁও চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের মাঠে চলছে দুই দিনব্যাপী ঈদ মেলা। সোমবার সকালে ঈদের নামাজ ও আনন্দ মিছিলের পর থেকে মেলায় দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়তে থাকে। ছোট শিশু ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অনেকেই মেলায় ঘুরছেন, ছবি তুলছেন ও কেনাকাটায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।
বিশেষ করে শিশুদের জন্য রাখা পাপেট ও কার্টুন চরিত্রের সামনে ছবি তুলতে ভিড় করছেন অভিভাবকরা। এ আয়োজনে অংশ নিয়ে দোকানিরাও আনন্দ উপভোগ করছেন।
দুই সন্তানকে নিয়ে আসা সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'চাকরির কারণে ঈদে বাড়ি যাওয়া সম্ভব হয় না। তবে এবারে ঢাকায় এক প্রাণবন্ত ঈদ উদযাপন করছি বাচ্চাদের নিয়ে। ওরা খুব খুশি মেলায় এসে, বিশেষ করে সুলতানি আমলের পাপেটগুলো দেখে ওরা মুগ্ধ।'
তিনি আরও বলেন, 'এমন আয়োজন শিশুদের খুব আনন্দ দেয়। তারা সুলতানি আমল সম্পর্কে জানত না, কিন্তু এখন তারা আগ্রহ পাচ্ছে। শিশুদের মেধা বিকাশের জন্য এটি অসাধারণ আয়োজন।'
মেলায় অংশ নেওয়া প্রত্যাশা কিচেনের মো. ফয়সাল সরকার আহমেদ বলেন, 'আমরা দোকান নিয়ে এসেছি গোরান থেকে। ঈদ আনন্দের সঙ্গে ব্যবসার আনন্দ উপভোগ করছি। মানুষ প্রচুর সাড়া দিচ্ছে, সবাই উপভোগ করছে।'
জুস বিক্রি করছিলেন নুরুন্নবী পিঠা ঘরের রানা মিয়াজী। তিনি টিবিএসকে বলেন, 'এত মানুষের সঙ্গে ঈদ করছি, ভাবতেই অবাক লাগছে। মানুষের চাহিদা অনুযায়ী জুস দিয়েও শেষ করতে পারছি না! পরিবারের সঙ্গে না থাকলেও সবার সঙ্গে ঈদ উদযাপন করে দারুণ লাগছে। এটাই আমাদের ঈদের বড় আয়োজন। চাই, এমন আয়োজন আরও বাড়ুক।'
            
                                                        
                                                        
                                                        
                                                        
                                                        
                                                        
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: