যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপে বাংলাদেশে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না: দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

মুনা নিউজ ডেস্ক | ১৭ মে ২০২৫ ১৯:২৯

ফাইল ছবি ফাইল ছবি

যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপকে টক্সিক থেরাপি বা বিষাক্ত শুল্ক চিকিৎসা বলে মন্তব্য করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, নতুন প্রেসিডেন্ট দায়িত্বে আসার পরে যেই শুল্কটা আরোপ করেছেন, সেটির পেছনে অর্থনীতির চেয়েও বেশি রাজনীতি রয়েছে। কিন্তু পাল্টা শুল্ক আরোপের যে নীতি তিনি নিয়েছেন সেটি সফল হবে কিনা তার ব্যাপারে আমাদের দৃঢ় সংশয় রয়েছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপ নিয়ে আমরা যতখানি ভয় পাচ্ছি, এত ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আমি দায়িত্ব নিয়েই কথাটা বললাম। এর কারণ, শুল্ক আরোপের ফলে প্রভাব আমাদের প্রতিযোগীদের (দেশ) ওপরেও পড়ছে। ফলে তুলনামূলক প্রতিযোগিতায় আমরা খুব বেশি হারছি না।

শনিবার (১৭ মে) রাজধানীর মতিঝিলে ডিসিসিআই কার্যালয়ে ‘যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক নীতি ও বাংলাদেশের করণীয়’ বিষয়ে আয়োজিত সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে তিনি এসব কথা বলেন। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) এবং বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড) যৌথভাবে এ সেমিনার আয়োজন করে, অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান।

যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপকে টক্সিক থেরাপি বা বিষাক্ত শুল্ক চিকিৎসা বলে মন্তব্য করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, নতুন প্রেসিডেন্ট দায়িত্বে আসার পরে যেই শুল্কটা আরোপ করেছেন, সেটির পেছনে অর্থনীতির চেয়েও বেশি রাজনীতি রয়েছে। কিন্তু পাল্টা শুল্ক আরোপের যে নীতি তিনি নিয়েছেন সেটি সফল হবে কিনা তার ব্যাপারে আমাদের দৃঢ় সংশয় রয়েছে। অর্থাৎ এই নীতি দিয়ে উনি যে লক্ষ্য থেকে অর্জন করতে চাচ্ছেন, এটা কার্যকর হবে বলে মনে হয় না। বাজার এটাকে সেভাবে গ্রহণ করবে না।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, প্রথম কথা হলো যে নীতিতে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সে নীতিটি খুব একটা সঠিক না। শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রে যে সূচক (পণ্য বাণিজ্য ঘাটতি) তারা ব্যবহার করেছেন সেটিও কার্যকর কিছু না। তারা বলছেন, পণ্যের ক্ষেত্রে যার সঙ্গে যত বাণিজ্য ঘাটতি তার ওপরে তত বেশি শুল্ক দিয়ে দাও। কিন্তু বর্তমানে পৃথিবীতে সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি অনেক বেশি। ফলে পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্য কিন্তু তারা বিবেচনায় নেয়নি। আবার চলতি বছর আপনি যে বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে, সেটি পরবর্তী বছর একই থাকবে না, পরিবর্তন হবে। তাহলে কী বছর বছর তারা শুল্ক বদলাবে? আর বছর বছর শুল্ক বদলালে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে স্থিতিশীলতা দরকার সেটি থাকবে না।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, কোনো নীতি যদি যৌক্তিক না হয় তাহলে তাকে স্থায়িত্ব দেয়া খুবই কষ্টকর। বাজারে এটাকে গ্রহণ করে না। তবে যখন কোনো ধরনের দুর্যোগ আসে সেটিকে সুযোগ হিসেবে দেখতে হবে। অনেকদিনের জমে থাকা যেসব সংস্কারের কথা আমরা বলে থাকি, এগুলোকে বাস্তবায়ন করার এটি সুযোগ, এটি উচিত সময়।

বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ইস্যুতে আমরা বহুপক্ষীয় আলোচনার পরিবর্তে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে আমরা ঠিক পথেই আগাচ্ছি। এজন্য বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) আনুষ্ঠানিক কোনো এজেন্ডা দেইনি।

মাহবুবুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ১০০টি পণ্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এর পাশাপাশি তৃতীয় যেসব দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য আমদানি করা হয়, সেগুলোকে হিসাবের মধ্যে ধরার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। আমরা তাদের পণ্য কিনব, কিন্তু সেটি ওই দেশের সঙ্গে মোট বাণিজ্যের হিসাবে যোগ হবে না- আমরা তা বরদাশত করব না। ফলে যুক্তরাষ্ট্র এতে রাজি না হলে আমরা আমদানি নীতি সংশোধন করে তৃতীয় দেশ থেকে পণ্য আমদানি নিষেধ করে দেব।৷এরই মধ্যে এই পদ্ধতি গাড়ির ক্ষেত্রে রয়েছে। এছাড়া বাণিজ্য বাধা দূর করতে তেজস্ক্রিয় পরীক্ষা পদ্ধতি তুলে নেয়াসহ আরো কিছু পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।

সেমিনারের নির্ধারিত আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. মেসবাউল হক, ঢাকা চেম্বারের প্রাক্তন সভাপতি ও শাশা ডেনিমস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ, পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সিইও ড. এম মাশরুর রিয়াজ এবং বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার রাজিব হায়দার অংশগ্রহণ করেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. মেসবাউল হক বলেন, বাজারে টাকার সরবরাহ বেশ ভালো, তবে শিল্প খাতের আর্থিক চাহিদা মেটাতে ব্যাংক খাতের ওপর বেশি নির্ভরশীল হওয়ায়, ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর চাপ প্রতিনিয়িত বাড়ছে। আর্থিক খাতের বাজারে কাঠামোগত দক্ষতা বাড়ানো না গেলে, আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে না বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।

পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সিইও ড. এম মাশরুর রিয়াজ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কী চায় এবং তাদের ভূ-অর্থনৈতিক প্রাধিকার কী সেটা আমাদের আগে জানতে হবে এবং সে অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তুলা, সয়াবিন, এলএনজি-এ তিনটি পণ্যের আমদানি বাংলাদেশে ক্রমাগত বাড়ছে, তাই এ ধরনের সম্ভাবনাময় পণ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে। মাশরুর রিয়াজ বলেন, দীর্ঘমেয়াদে আমাদের প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়াতে লজিস্টিক খাতে সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই, কারণ পার্শ্ববর্তী প্রতিযোগী দেশের চাইতে এ খাতে আমাদের ব্যয় তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।

ঢাকা চেম্বারের প্রাক্তন সভাপতি ও শাশা ডেনিমস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ভোক্তাদের চাহিদা কমার ফলে আমাদের রফতানি কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। তিনি বলেন, তৃতীয় কোনো দেশ হতে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে তারা যেন বিষয়টিকে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র হতে আমদানি হিসেবে গণ্য করে, তা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা পর্বে উত্থাপন করতে হবে। বর্তমান সরকার যে সংস্কার কার্যক্রম গুলো হাতে নিয়েছে, তা স্বল্প সময়ে বাস্তবায়নের ওপর তিনি জোরারোপ করেন।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস্ অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার রাজিব হায়দার বলেন, চাহিদামতো জ্বালানি সরবরাহ না থাকার কারণে বস্ত্র খাতের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজের প্রায় ৪০ শতাংশ উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে, তাই শিল্পের চাহিদা মেটাতে এলএনজি আমদানির ওপর তিনি জোরারোপ করেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের তুলা তুলনামূলক বেশ দামি এবং গুণগত মানও বেশ ভালো, তবে আমদানিতে তিনমাসের বেশি সময় লেগে যাওয়ায়, এ খাতের উদ্যোক্তারা তুলা আমদানিতে নিরুৎসাহিত হন। এ সমস্যা সমাধানে আমেরিকার তুলা রফতানিকারকদের বাংলাদেশে ওয়্যারহাউজ সুবিধা প্রদান করা হলে, তুলার আমদানি চারগুণ বৃদ্ধি পাবে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: