একটি সুন্দর নির্বাচন আয়োজনই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য : প্রধান উপদেষ্টা

মুনা নিউজ ডেস্ক | ১২ জুন ২০২৫ ১১:৫৬

ছবি : সংগৃহীত ছবি : সংগৃহীত

১৭ বছর পর সরকার ইতিহাসের সবচেয়ে সুন্দর নির্বাচন আয়োজন করতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ১৭ বছর পর আমরা সত্যিকারের একটি নির্বাচন করতে যাচ্ছি; যা আমাদের ইতিহাসে সবচেয়ে সুন্দর নির্বাচন হবে। তার আগে রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে সরকার সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করবে। যেটি ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের ভিত তৈরি করবে।

এ ছাড়াও নির্বাচিত সরকারের কোনো দায়িত্বে থাকারও ইচ্ছে নেই বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেয়া নোবেল বিজয়ী এ অর্থনীতিবিদ। বুধবার বৃটেনের লন্ডনের চ্যাথাম হাউসে রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সে সাক্ষাতকারে তিনি এসব কথা বলেন। সঞ্চালকের পাশাপাশি এদিন সাংবাদিকরাও বাংলাদেশের সরকারপ্রধানকে প্রশ্ন করেন। সেখানে তিনি নির্বাচন, সংস্কার, জুলাই গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগের বিচারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলেন।

প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, নির্বাচনের পর গঠিত পরবর্তী সরকারের অংশ হওয়ার কোনো আগ্রহ আমার নেই। আমাদের কাজ হলো যে রূপান্তর চলছে সেটি ঠিকমতো শেষ করে সফল ও শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা, যা নির্বাচন দ্বারা সম্পন্ন হবে। জনগণ যেন সন্তুষ্ট থাকে। তিনি এ-ও বলেন যে, তার উপদেষ্টা পরিষদের কোনো সদস্য সেটা করতে আগ্রহী হবেন না।

ড. ইউনূস বলেন, আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে নির্বাচনটি সঠিকভাবে সম্পন্ন হবে। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তিনি বলেন, আমি যেটা বলে আসছি সেটা হচ্ছে- এবার ইতিহাসের সেরা এবং সবচেয়ে সুন্দর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কেননা এখনই সঠিক সময়। জনগণও এর জন্য প্রস্তুত। বহু বছর পর নির্বাচন হচ্ছে। ১৭ বছরের মধ্যে এবারই সত্যিকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। যা নিয়ে দেশে উৎফুল্লতা রয়েছে। কেননা, এবার জনগণ সত্যিকার অর্থে তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিতে পারবে।

গত ১৭ বছরে তরুণদের বিশাল একটি অংশের ভোটের বয়স হয়েছে। তারা এখনো নিজেদের ভোটদানের প্রথম সুযোগ পায়নি। সুতরাং আসন্ন নির্বাচন তরুণদের জন্য দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষার ফল। সুতরাং আমি এসব তরুণ-তরুণীদের জন্য কাজ করারই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। যারা দীর্ঘসময় অপেক্ষার প্রহর গুনছে। অন্যদের মতো তাদের আওয়াজ কখনো আমলে নেয়া হয়নি। যেটা অন্যান্য জাতিরা করে থাকে। সুতরাং আমরা এই উচ্ছ্বাস ব্যবহার করে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাই। এটা কোনো সরকার নির্বাচিত করার নিয়মরক্ষার নির্বাচন নয়। এটা হবে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের নির্বাচন। আমরা এর প্রতিশ্রুতিই দিয়েছিলাম। আমাদের এই দায়িত্বই দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে তরুণদের স্বপ্নের আদর্শ নিশ্চিত করা হবে যারা কিছুদিন আগেই তাদের রক্ত বিসর্জন দিয়েছে।

তিনি বলেন, আমরা এই দায়িত্ব নেয়ার আগে তারা তরুণরা রক্ত দিয়েছে। আমরা তাদের ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানাই। তাদের স্বপ্নকে শ্রদ্ধা করি। আমরা পুরনো বাংলাদেশকে বিদায় জানিয়ে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে চাই।

তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে আমরা নতুন বাংলাদেশের সংজ্ঞায়ন করি। প্রথমত, সংস্কার। আমরা পুরনো প্রাতিষ্ঠানিক ধারায় ফিরে যেতে চাই না। সুতরাং আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সংস্কার করতে হবে। এর জন্য আমরা একাধিক কমিশন গঠন করেছি। যারা এ বিষয়ে পঠন-পাঠন করবে এবং আমাদের সুপারিশ করবে। যার মাধ্যমে মৌলিক পরিবর্তন সাধন করা হবে। এ বিষয়ে আমাদের একাধিক কমিশন রয়েছে যারা তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছে। যেখানে সংস্কারের লক্ষ্যে অনেক সুপারিশ দেয়া হয়েছে। যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমূল পরিবর্তন করার সুপারিশও রয়েছে। এর মধ্যে নির্বাচন, সংসদ, সংবিধান, সিভিল সার্ভিসসহ অন্যান্য বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এসব বিষয়ে বহু সুপারিশ রয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমাদের কাজ হচ্ছে সকল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা। সুতরাং আমরা সর্বশেষ একটি কমিশন গঠন করেছি। যার নাম জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। আপনারা কী এ বিষয়ে শুনেছেন? আমরা কিন্তু এটা করেছি। এই কমিশন সকল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে। বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে এ বিষয়টি মোটেও সহজ কাজ নয়। ভোটের আগের নিয়মে আমরা যেতে চাই না। আগের চিত্র ছিল তুমি আমাকে টাকা দাও, আমি তোমাকে ভোট দেই। বলতে গেলে এটা খুব সহজই। ভোট দেয়ার অর্থ শুধু এটুকুই বুঝাতো। তাই বলেছি, আমরা পুরোনো পদ্ধতিতে ফিরে যেতে চাই না। আর এসব বিষয় গণমাধ্যমে নিত্যদিনের খবর হচ্ছে।

তাই আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো সুপারিশগুলোর বিষয়ে সকল পক্ষকে এক জায়গায় নিয়ে আসা। এরপর আমরা সুপারিশমালায় সকল রাজনৈতিক দলের স্বাক্ষর সংগ্রহ করবো। যেটাকে আমরা জুলাই সনদ বলছি। এই সনদ আসন্ন মাসেই দেখতে পাবো।

নির্বাচনকে সামনে রেখেই আমরা জুলাই সনদ উদ্‌যাপন করবো। সুতরাং নির্বাচনের লক্ষ্যে আমাদের প্রথম এজেন্ডা হচ্ছে সংস্কার। এরপর বিচার। যে সকল ব্যক্তিরা অপরাধ করেছে তাদের বিচার করা। যা যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তা আমি আর বিশদ বর্ণনা করতে চাই না। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ভয়ংকর এক অধ্যায় ঘটে গেছে। রাস্তায় মানুষ নেমেছে তারা আর বাসায় ফিরে আসেনি। বাবা-মায়ের ছেলে, মেয়েরা সড়কে গিয়েছে, তারা আর বাসায় ফিরে আসেনি। বন্ধুরা একজন আরেক জনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আন্দোলনে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। হয় একজন নিহত হয়েছে বা উভয়ই। আমাদের এজেন্ডার মধ্যে সর্বশেষ হচ্ছে নির্বাচন। যা নিয়ে এখন আমরা কথা বলছি।

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের বিষয়ে তিনি বলেন, যদিও এটা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। বিতর্কটা হচ্ছে আওয়ামী লীগ হচ্ছে একটি রাজনৈতিক দল। তারা কী ছাত্র-জনতাকে এভাবে রাস্তায় হত্যা করতে পারে? এভাবে গুম করতে পারে? এভাবে অর্থপাচার করতে পারে? এরপরও আপনি সেটাকে রাজনৈতিক দল বলবেন। এটা বিতর্ক। আমি এ বিষয়ে চূড়ান্ত মত দিচ্ছি না। এই ইস্যুটি গত বছরের ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দেশ ছেড়ে পালানোর পর সামনে এসেছে। দীর্ঘ স্বৈরাচারী শাসনের পর তার পতনে দেশের মানুষ উল্লাস প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে যে, অবশেষে আমরা মুক্ত হয়েছি। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা বলছি যে এই রাজনৈতিক দল শেষ।

এখন আওয়ামী লীগহীন বাংলাদেশ। কিন্তু তিনি (শেখ হাসিনা) দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পরও থেমে যাননি। তারা বাইরে থেকে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। অভ্যুত্থানের দশ মাস হলেও দলটির কোনো নেতা এখনো জাতির কাছে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চায়নি। এসব বিষয় সামনে রেখে সাময়িকভাবে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাদের পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়নি। বিচার শেষ হওয়া পর্যন্তই তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকবে। এদিকে আসন্ন জুলাই সনদ জনমতের জন্য গণভোটের আয়োজন করা হবে না বলে জানিয়েছেন সরকারপ্রধান। তিনি বলেন, গণভোট এখানে অর্থহীন। কারণ মানুষ এ জটিল বিষয়গুলো পুরোপুরি বুঝবে না। যদি সব দল জাতীয় ও রাজনৈতিক বিষয়ে সম্পৃক্ত হয়, যেসব বিষয়ে তারা বোঝা ও বিতর্ক করে তাহলে সেটি গণভোটের থেকে বেশি বাস্তব হবে।

ড. ইউনূস আবারো আশ্বস্ত করেন যে, ২০২৬ সালের এপ্রিলে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে চান। এ সময় তিনি দেশ যে রূপান্তরের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে তার মূল বিষয়গুলো তুলে ধরেন। সেগুলো হলো- সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচন। এ সময় সংবাদমাধ্যমে স্বাধীনতা নিয়েও কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। বলেন, সংবাদমাধ্যম আগে কখনো এতো স্বাধীনতা পায়নি যা তারা এখন ভোগ করছে।

তারা এখন যেকোনো বিষয় লেখতে ও বলতে পারছে। এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ভাঙা নিয়েও কথা বলেন। বলেন, একসঙ্গে অনেক ইস্যু এসেছিল। আমরা সবকিছু একসঙ্গে সামাল দিতে পারিনি। এটা একটা সময়কাল ছিল, যেটা আমরা পার হয়ে এসেছি। এখন পরিস্থিতি শান্ত।

তিনি জোর দিয়ে বলেন, জুলাই সনদে সব রাজনৈতিক দলই অবদান রাখছে। একটি দেশে বিপ্লবের এক বছরের মধ্যেই যদি এমন ঐক্য আসে, তাহলে সেটাই সবচেয়ে বড় ঐক্য। ওদিকে গতকাল যুক্তরাজ্যের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জনাথন পাওয়েল লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তার হোটেলে সাক্ষাৎ করেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। তবে বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে সেটি জানানো হয়নি। এদিকে আগামী বছরের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক সংস্কারে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে আগ্রহী কমনওয়েলথ।

সংস্থাটির মহাসচিব শার্লি আয়র্কর বোচওয়ে বলেন, বাংলাদেশ যদি চায়, বিশেষ করে সাংবিধানিক সংস্কারের জন্য, তাহলে আমরা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। মঙ্গলবার লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতকালে তিনি এ আগ্রহের কথা জানান। বলেন, গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে সহায়তা করা আগামী পাঁচ বছরের জন্য কমনওয়েলথের অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সংগ্রামে সহায়তা করাও সংগঠনের অগ্রাধিকারভিত্তিক লক্ষ্য।

তিনি বলেন, বর্তমানে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৮৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং আগামী কয়েক বছরে তা কমপক্ষে ১ ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। শার্লি আয়র্কর বোচওয়ে বলেন, কমনওয়েলথের অনেক সদস্য রাষ্ট্র জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এবং এর মধ্যে অনেক দেশ আকারে অত্যন্ত ছোট। আমরা তাদের জলবায়ু অর্থায়নে প্রবেশাধিকার পেতে সহায়তা করার চেষ্টা করবো।

এ সময় জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, এসডিজি বিষয়ক সিনিয়র সচিব লামিয়া মোরশেদ এবং যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের হাইকমিশনার আবিদা ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: