
গঙ্গা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি নবায়ন সামনে রেখে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনের সদস্যরা আগামী মঙ্গলবার দিল্লিতে বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন। বৈঠকে অংশ নিতে যৌথ নদী কমিশন বাংলাদেশের সদস্য আবুল হোসেনের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল আগামীকাল সোমবার ঢাকা থেকে দিল্লির উদ্দেশে রওনা হবেন।
যৌথ নদী কমিশন বাংলাদেশের সদস্য আবুল হোসেন শনিবার বলেন, এটি কমিশনের নিয়মিত মিটিং। এ মিটিংয়ে সাধারণত গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি ঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, অর্থাৎ চুক্তি অনুযায়ী নদীর পানি ভাগাভাগি হচ্ছে কি না সেটা দেখা হয়। জানুয়ারি থেকে মে সময় পর্যন্ত ফারাক্কা ব্যারেজে দুই দেশের প্রতিনিধি থাকেন। তারা প্রতিদিন চারবার করে পানি পরিমাপ করেন এবং ১০ দিনের গড় হিসাব করে দুই দেশ কতটুকু পানি পেল, সেটা দেখা হয়। এ মিটিংয়ের আনুষ্ঠানিক আলোচনা মূলত এসব বিষয়ে। তবে আমরা অন্যান্য বিষয়েও অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা করে থাকি।
তিনি বলেন, শুষ্ক মৌসুমে চাহিদা অনুযায়ী পানি গঙ্গা নদীতে থাকে না। ফলে গড়াই নদীতে পানির প্রবাহ কমে যায়, সুন্দরবন পানি পায় না। এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি অনেক বছর ধরে বাংলাদেশ হচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গঙ্গা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি নবায়নের সময় বাংলাদেশ গড়ে ৪০ হাজার কিউসেক পানি চাইবে। পাশাপাশি চুক্তিটি দীর্ঘমেয়াদি করার পরিকল্পনা রয়েছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে।
কমিশনের এই সদস্য আরও বলেন, তবে এ বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় এখনো শুরু হয়নি। আলোচনা শুরু করা সরকারের সিদ্ধান্ত। আমরা যৌথ নদী কমিশন প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। ভারত কী কী চাইতে পারে সেই বিষয়েও আমাদের ধারণা রয়েছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের চাহিদা কী হতে পারে সেটাও প্রস্তুত করা হয়েছে।
সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে ধরলা, দুধকুমার, গোমতী, খোয়াই, মনু ও মুহুরীসহ মোট ১৪টি নদীর পানিবণ্টন চুক্তি করার বিষয়ে বাংলাদেশ প্রস্তাব করবে। বাংলাদেশ চায় উভয় দেশ আন্তর্জাতিক পদ্ধতি মেনে এসব নদীর পানি ব্যবহার করুক।
উজানের পানির চাপে বাংলাদেশে যেহেতু বন্যা হয়, সেজন্য বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে বন্যা পূর্বাভাস মডেল তৈরি করতে চায়। নদী কমিশনের বৈঠকে এই মডেল তৈরি ও সরাসরি তথ্য বিনিময় করার প্রস্তাবও থাকবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ জয়েন্ট ফ্লাড ফোরকাস্টিং সিস্টেম দাঁড় করাতে চায়।
এছাড়া যৌথ নদীতে কোনো ধরনের খনন, বাঁধ নির্মাণ, ড্রেজিং সংক্রান্ত কার্যক্রম ও সংস্কার করতে হলে এক দেশ থেকে অন্য দেশের অনুমোদন নিতে হয়। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বিভিন্ন নদীর বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক জায়গায় ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন নদীর বাঁধ সংস্কার ও ড্রেজিংয়ের কাজের অনুমোদন চাওয়া হবে কমিশনের বৈঠকে।
গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তি
১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তি হয়। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবগৌড়া ও বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩০ বছর মেয়াদি এই চুক্তি করেন।
২০২৬ সালের ডিসেম্বরে এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। ২০২৪ সালে হাসিনার ভারত সফরের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানিয়েছিলেন, গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তি নবায়ন নিয়ে দুই দেশ বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে পর্যালোচনায় রাজি হয়েছে।
কিন্তু গত বছরের আগষ্টে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কে আগের মতো উষ্ণতা নেই। অনেক ক্ষেত্রেই দুই দেশের সরকার প্রকাশ্যে একে অপরের সমালোচনা করে আসছে।
ভারতীয় গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিতের পর এবার বাংলাদেশের সঙ্গেও আগামী বছর মেয়াদ শেষ হতে যাওয়া গঙ্গা নদীর পানিবণ্টন চুক্তির শর্ত পুনঃআলোচনা করে ঠিক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সূত্রগুলোর বরাত দিয়ে দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এক প্রতিবেদনে বলেছে, নয়াদিল্লি ঢাকাকে জানিয়েছে, উন্নয়ন চাহিদা মেটাতে ভারতের আরো পানিসম্পদের প্রয়োজন। এছাড়া, নতুন চুক্তিটিও হবে আগের চেয়ে স্বল্পমেয়াদি, সম্ভবত ১০ থেকে ১৫ বছরের।
দেশটির সরকারি সূত্রগুলোর ভাষ্য, এই স্বল্পমেয়াদি চুক্তির লক্ষ্য— দুই দেশকে নমনীয়তা ও অভিযোজনযোগ্য সময় দেওয়া— যাতে ভবিষ্যতে পানি ভাগাভাগির ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন আনা যায়।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে। গঙ্গা ছাড়া আর কোনো নদীর পানিবণ্টনের চুক্তি হয়নি। তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে অনেকদিন ধরে আলোচনা হলেও তা চুড়ান্ত রূপ পায়নি।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: