12/24/2025 ২০২৫: পাকিস্তান–যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তন
মুনা নিউজ ডেস্ক
২৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৮:২২
২০২৫ সালের শুরুর দিকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তা সম্পর্ক মোটেও বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল না। তখন ইসলামাবাদকে দেখা হতো তালেবানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে; রাজনৈতিকভাবে তাদের অবস্থান ছিল প্রশ্নবিদ্ধ এবং কূটনৈতিকভাবে তারা ছিল প্রায় বিচ্ছিন্ন। ২০২২-২৩ সালের ভয়াবহ বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে জিডিপিতে কিছুটা প্রবৃদ্ধি এলেও পাকিস্তানের অর্থনীতি তখনো বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরশীল ছিল।
ওয়াশিংটন পাকিস্তানকে অবিশ্বস্ত এবং কম কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ হিসেবে মনে করত। দেশটির শক্তিশালী নিরাপত্তা সংস্থাকে দেখা হতো রহস্যময় হিসেবে, যারা একই সঙ্গে দুই পক্ষের সঙ্গে চলে এবং সন্ত্রাস দমনে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে চায় না। বিশ্লেষকেরা সতর্ক করেছিলেন, পাকিস্তান এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় নিরাপত্তাসংকটে পড়তে যাচ্ছে।
অথচ ২০২৫ সালের শেষে এসে দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তান ব্রাত্য দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারে পরিণত হয়েছে। খুব কম দেশের ক্ষেত্রেই এত দ্রুত বা নাটকীয়ভাবে ভাবমূর্তির পরিবর্তন ঘটে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক নতুন পররাষ্ট্রনীতিতে পাকিস্তান এখন প্রধান এক স্তম্ভ।
শুরুতে ট্রাম্পের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টারাও পাকিস্তানকে নিয়ে অস্বস্তিতে ছিলেন। বিশেষ করে চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তাঁদের চিন্তার কারণ ছিল। পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষ প্রায়ই গর্ব করে বলত, চীনের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্ব ‘সমুদ্রের চেয়ে গভীর আর পাহাড়ের চেয়ে উঁচু’।
ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি–সংশ্লিষ্ট মহলের প্রত্যাশা ছিল স্পষ্ট—ভারতকে দ্বিগুণ সমর্থন দাও, ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলে ‘কোয়াড’কে শক্তিশালী করো এবং ভারতের স্বার্থরক্ষায় ইসলামাবাদকে এক পাশে সরিয়ে রাখো।
কিন্তু ওয়াশিংটন যখন ভারতকে অগ্রাধিকার দেওয়ার নীতিতে ঝুঁকে পড়ছিল, তখনই ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, নাগরিক স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা এবং সামরিক শক্তির অকার্যকারিতা নিয়ে উদ্বেগ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। দীর্ঘদিন ধরে এসব সমস্যা এড়িয়ে যাওয়া হলেও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে ভারতের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হতে থাকে।
বরফ গলতে শুরু করার প্রথম লক্ষণ ছিল সন্ত্রাসবাদ দমনে দুই দেশের মধ্যে কিছু গোপন তথ্য বিনিময়। এতে বোঝা যাচ্ছিল, ইসলামাবাদ অবশেষে কার্যকর সহযোগিতা দিতে ইচ্ছুক। এরপর গত মার্চ মাসে যখন ট্রাম্প হঠাৎ করেই এক ভাষণে পাকিস্তানের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন, তখন ওয়াশিংটন অবাক হয়ে যায়।
দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত নীতির বাইরে গিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই মন্তব্য ‘ডিসি ব্লব’কে (ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারক মহল) এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি করে দেয়। ট্রাম্পের নতুন নীতিতে পাকিস্তানকে নতুন ও শক্তিশালী এক মিত্র হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ইসলামাবাদ এই সুযোগ হাতছাড়া করেনি। পাকিস্তানের প্রতিটি ছোট সহযোগিতার বিপরীতে ওয়াশিংটন থেকে অপ্রত্যাশিত সমর্থন মিলছে, যা তাদের আরও উৎসাহিত করছে। দীর্ঘদিনের লেনদেনভিত্তিক নড়বড়ে সম্পর্ক এক গভীর গুরুত্বের দিকে মোড় নিতে শুরু করেছে। ট্রাম্প প্রশাসনের যেসব কর্মকর্তা একসময় পাকিস্তানকে অবজ্ঞা করতেন, এখন তাঁরা পাকিস্তানকে দায়িত্বশীল ও নমনীয় বন্ধু হিসেবে বর্ণনা করছেন।
সম্পর্কের মোড় ঘুরে যাওয়ার চূড়ান্ত মুহূর্তটি ছিল মে মাসে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সংক্ষিপ্ত কিন্তু তীব্র সামরিক সংঘাত। এই সংঘাতে পাকিস্তানের দক্ষতা দেখে ট্রাম্প স্তম্ভিত হয়ে যান। পাকিস্তানের সামরিক শৃঙ্খলা এবং কৌশলগত ক্ষমতা ওয়াশিংটনকে নতুন করে ভাবাতে শুরু করে।
যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের যাঁরা পাকিস্তানকে ক্ষয়িষ্ণু শক্তি হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন, তাঁরা আবারও দেশটিকে একটি শক্তিশালী আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে গণ্য করতে শুরু করেন। ট্রাম্পের কাছে পাকিস্তান এখন তাঁর দক্ষিণ এশিয়া কৌশলের একটি বড় সম্পদে পরিণত হয়েছে।
এই নতুন গুরুত্বের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক আধুনিকায়নও গতি পেয়েছে। সামরিক কমান্ড কাঠামো সংস্কার করে ‘চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস’ নামে নতুন একটি পদ তৈরি করা হয়েছে, যাতে এখন আসীন আছেন ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। একই সঙ্গে পাকিস্তানের সেনাপ্রধানও তিনি।
আরেকটি বড় বিষয় ছিল ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি। ট্রাম্প যখন মধ্যস্থতা করতে চেয়েছিলেন, তখন ভারত তা প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু পাকিস্তান কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। ‘যুদ্ধ শুরু নয়, শেষ করায়’ বিশ্বাসী—ট্রাম্পের মতো একজন নেতার প্রস্তাবের পর ভারতের আচরণ সম্ভবত তাঁকে আহত করেছে। এতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ওয়াশিংটনে পাকিস্তানের গুরুত্ব বহুগুণ বেড়ে যায়।
ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মহলে এখন উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে দেখা হচ্ছে ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরকে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের রসায়নকে উপদেষ্টারা ঠাট্টা করে ‘ব্রোমান্স’ বা গভীর বন্ধুত্ব হিসেবে অভিহিত করছেন। ওয়াশিংটনের রাজনীতিতে আসিম মুনির এখন এক রহস্যময় ও সুশৃঙ্খল ব্যক্তিত্ব। পাকিস্তান সরকারও এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ট্রাম্পের মন জয় করতে নানা কৌশলী পদক্ষেপ নিচ্ছে।
পুরস্কার হিসেবে আসিম মুনির হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজের আমন্ত্রণ পান, যা পাকিস্তানের কোনো সামরিক প্রধানের ইতিহাসে প্রথম। ক্যামেরা এই দৃশ্য দারুণভাবে লুফে নেয়। আর ট্রাম্প নিজে এটিকে আরও বেশি উপভোগ করেন। রাতারাতি পাকিস্তানের প্রতি সন্দেহ ও সতর্কতার বদলে মুগ্ধতা ও উদ্যাপনের বাতাবরণ তৈরি হয়।
২০২৬ সালের শুরুতে পাকিস্তান ট্রাম্পের দক্ষিণ এশিয়া ও দূরপ্রাচ্য কৌশলের কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে পাকিস্তানের গুরুত্ব এখন অনেক—সেটি হতে পারে ইরানের সঙ্গে যোগাযোগের গোপন পথ হিসেবে, গাজা সংকট সমাধানে অথবা এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব কমাতে একটি ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তি হিসেবে।
এর ফলে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক প্রায় প্রতিটি আলোচনায় পাকিস্তান এখন এক অপরিহার্য নাম। ওয়াশিংটনের ‘ভারত প্রথম’ যুগের আপাতত অবসান ঘটেছে। যদিও পরিস্থিতি ভবিষ্যতে দিল্লি ও ইসলামাবাদের আচরণের ওপর নির্ভর করবে।
২০২৫ সালে পাকিস্তানের এই রূপান্তর ভূরাজনীতিতে এক অনস্বীকার্য প্রভাব ফেলেছে। ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে পাকিস্তান এখন এক গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
A Publication of MUNA National Communication, Media & Cultural Department. 1033 Glenmore Ave, Brooklyn, NY 11208, United States.