01/01/2026 ক্ষমতা, শোষণ এবং মুছে ফেলা মানবতার বিরুদ্ধে একটি তীব্র কাব্যিক প্রতিবাদ
মুনা নিউজ ডেস্ক
৩১ ডিসেম্বর ২০২৫ ২০:২০
সমকালীন সাহিত্যে কখনো কখনো এমন কবিতা আসে, যা সরাসরি মানুষের অস্তিত্ব, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন এবং অর্থনৈতিক শোষণের কাঁটাযুক্ত বাস্তবতাকে উদঘাটন করে। ‘লাভায় লালশাক পুবের আকাশ ‘(২০২৪) কাব্যগ্রন্থের ‘আমায় ছিঁড়ে খাও হে শকুন’ কবিতাটিতে ঠিক তেমনই এক সাহসী, নির্মম এবং ভয়ঙ্কর আলোকপাত রয়েছে।
কবি হাদী নিজেকে “ছিঁড়ে খাও হে শকুন, হে সীমান্তের শকুন”
আহ্বানে শুরু করেছেন। কবিতায় তিনি চরম প্রতিবাদের মশাল ধ্বনি আওড়িয়েছেন। শকুন, ঈগল, বাজের মতো হিংস্র পাখির প্রতি যে আহ্বান তা রাষ্ট্র, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রতীক হিসেবে দেখিয়েছেন। কবিতার প্রতীক ব্যবহারের তীক্ষ্ণতা পাঠকের নজরকাড়া।
“আটলান্টিকের ঈগল” বা “বৈকাল হ্রদের বাজ”-এই ভৌগোলিক সীমারেখার প্রশ্নে নিপীড়ন ও শোষণ কোনো দেশ বা সীমান্তের মধ্যে নয় আন্তর্জাতিক ও বহুমাত্রিকও। কবি হাদী কবিতার কেন্দ্রীয় প্রতীক শরীর, কেবল শারীরিক অস্তিত্ব নয়; এটি সামাজিক ও রাজনৈতিক যন্ত্রণা বহন করে বলে বুঝাতে চেয়েছেন। এই কবিতার উল্লেখযোগ্য আরেকটি লাইন” কাগজের কামলারা তারে আদর করে মুদ্রাস্ফীতি ডাকে। ঋণের চাপে নীল হয়ে যাচ্ছে আমার অণুচক্রিকা” তিনি অর্থনীতির পরিসংখ্যান খুলে বসাননি বরং বাস্তব জীবনের নিপীড়ন সরাসরি শারীরিক ভাষায় প্রকাশ করেছেন।
তেমনি “সংসার চালাতে অন্তরে হয় ইন্টারনাল ব্লিডিং” আধুনিক জীবনের এক অদৃশ্য, তীব্র যন্ত্রণার প্রতিফলন। তিনি কবিতায় দেখিয়েছেন ধর্ম এবং রাষ্ট্রের অবস্থানও আজ গভীরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। খোদার কাছে প্রাণের ব্যথা জানালে, উত্তর আসে”বেঁচে আছ কে বলল?” ঈশ্বর এখানে মুক্তিদাতা নয় যেন নীরব তত্ত্ব ও নিয়তির সাক্ষী। রাষ্ট্রীয় ক্রুঢ় ও নিখুঁত নিয়ন্ত্রক হিসেবে উপস্থিত রাজা, কোতোয়াল, ফরমান সব মিলিয়ে নাগরিকের একমাত্র কর্তব্য, “হাসতে থাকা”। এ যেন ব্যঙ্গাত্মক বাস্তবতার চিত্র যেখানে না হাসলে নাগরিকের জীবন বিপন্ন। মানবভক্ষণ ও ভোগবাদী সমাজের চিত্র কবিতার এক গুরুত্বপূর্ণ স্তর। সেখানে মানুষের মাংস, ভাগ্য, জীবন সবকিছু শোষণ ও ভোগের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। কী তীব্র অসহায়ত্বের বহিঃপ্রকাশ!
কবি হাদী জানিয়ে দেন, রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্যবাদ শুধু ক্ষমতা নয়; এটি মানবজীবনের প্রতি নির্মম আগ্রাসন। কিন্তু কবিতার সবচেয়ে শক্তিশালী অংশটি আসে শেষের দিকে। যেখানে তিনি আবারও শকুন, ঈগল, বাজদের ডাকেন, একমাত্র শর্তে ”দোহাই, শুধু মস্তিষ্কটা খেয়ো না আমার, তা হলে শীঘ্রই দাস হয়ে যাবে তোমরাও।” এখানে তিনি উদত্ত কন্ঠে বলেছেন মানুষের বুদ্ধি, চেতনা এবং সংবেদনশীলতাই শেষ প্রতিরক্ষা। শরীর ধ্বংস হতে পারে কিন্তু বুদ্ধি ধ্বংস মানেই শোষিতেরও পতন।
এই কবিতা কেবল কবির ব্যক্তিগত নিঃসঙ্গ আর্তনাদ নয়। এটি সমকালীন সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এক তীক্ষè, চরম, এবং বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবাদ। কবির ভাষা শক্তিশালী, চিত্রকল্প ভয়ংকর, ব্যঙ্গ তীক্ষè এবং প্রতিটি লাইন পাঠককে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায় মানবজীবনের ন্যায্যতা ও স্বাধীনতার প্রশ্নের দিকে। ‘আমায় ছিঁড়ে খাও হে শকুন’ এক প্রতিবাদী দলিল যা আমাদের সময়ের নির্মম বাস্তবতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে শিখায়।
A Publication of MUNA National Communication, Media & Cultural Department. 1033 Glenmore Ave, Brooklyn, NY 11208, United States.