
প্যারিসের কেন্দ্রস্থলের জাভেল মসজিদের দরজার সামনে রক্তমাখা শূকরের মাথা ফেলে রাখা হয় কিছুদিন আগে। সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখ ভোরে নামাজ পড়তে আসা মুসল্লিরা এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে যান। শূকরের মাথার ওপরে নীল কালি দিয়ে লেখা ছিল ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের নাম—‘মাখোঁ।’
আইফেল টাওয়ার থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই মসজিদে লেবানন, আলজেরিয়া, ইরানসহ বিভিন্ন দেশের মুসলিমরা নামাজ আদায় করেন। বহু বছর ধরে এলাকাটিতে প্রতিবেশীদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করছিলেন তাঁরা।
এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে মসজিদের রেক্টর নাজাত বেনালি বলেন, ‘আমাদের জীবনে এরকম কিছু আগে কখনো ঘটেনি।’
বেনালি জানান, খবর পেয়ে তিনি দ্রুত মসজিদে পৌঁছান। তিনি বলেন, ‘তাঁরা একেবারেই হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। যখন এরকম কিছু ঘটে, তখন স্বাভাবিকভাবেই সবাই আশপাশে খেয়াল করতে থাকে।’
পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে জানায়, শুধু জাভেল মসজিদ নয়, আরও আটটি মসজিদের সামনে একইভাবে শূকরের মাথা ফেলে রাখা হয়েছে।
প্যারিস পুলিশের প্রধান লরাঁ নুনেজ বলেন, ‘এর আগেও যেসব ঘটনা বিদেশি হস্তক্ষেপ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে, তার সঙ্গে এ ঘটনার মিল পাওয়া যায়।’
প্যারিস প্রসিকিউটরের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ৮ সেপ্টেম্বর রাতে সার্বিয়ান নাম্বারপ্লেটের গাড়িতে আসা দুই ব্যক্তি ফ্রান্সের উত্তরাঞ্চল নরম্যান্ডির এক কৃষকের কাছ থেকে প্রায় ১০টি শূকরের মাথা কিনেছিলেন। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, তাঁরা প্যারিসের ওবারকাম্প এলাকায় এসে এসব মাথা মসজিদের সামনে রেখে পরদিন ভোরে গাড়ি নিয়ে বেলজিয়ামে চলে যান।
প্রসিকিউটরের কার্যালয় এক বিবৃতিতে জানায়, ‘বিদেশি নাগরিকেরা ইচ্ছাকৃতভাবে এসব শূকরের মাথা মসজিদের সামনে রেখে সঙ্গে সঙ্গে দেশ ছেড়ে চলে যায়। উদ্দেশ্য ছিল দেশে অশান্তি তৈরি করা।’
প্রসিকিউটর লর বেকোয়া বলেন, ‘এর লক্ষ্য হলো মানুষকে অস্বস্তিতে ফেলা, নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা এবং শেষ পর্যন্ত সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করা।’
প্যারিসের পূর্বাঞ্চলীয় শহরতলি মন্ত্রুইয়ের ইসলাহ মসজিদের সামনে একইভাবে শূকরের মাথা ফেলে রাখা হয়েছিল। মসজিদ পরিচালনা কমিটির সদস্য হাজির রসুল বলেন, ‘প্রথমে আমরা খুব চিন্তিত হয়েছিলাম। এটা শান্তিপূর্ণ একটি এলাকা। আমরা প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভালোভাবেই থাকি। যখন শুনলাম শুধু আমাদের মসজিদ নয়, আরও কয়েকটি মসজিদকে টার্গেট করা হয়েছে, তখন অন্তত বুঝতে পারলাম এটা ব্যক্তিগত প্রতিশোধ নয়।’
এ ঘটনা ঘটল এমন সময়ে, যখন ফ্রান্সে মুসলিমবিদ্বেষী ঘৃণাজনিত অপরাধ বাড়ছে। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ১৪৫টি ইসলামবিরোধী ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭৫ শতাংশ বেশি। এসবের মধ্যে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা, হুমকি এবং হত্যাকাণ্ডও আছে। মে মাসে মালির নাগরিক আবুবাকার সিসেকে খুন করা হয়।
ফরাসি দৈনিক লিবেরাসিওঁর নতুন এক জরিপে দেখা গেছে, ফ্রান্সে প্রতি তিনজন মুসলিমের মধ্যে দুজনই গত পাঁচ বছরে বর্ণবাদী আচরণের শিকার হয়েছেন।
ফরাসি মানবাধিকারকর্মী সাফিয়া আইত ওয়ারাবি বলেন, ‘আমার বাবা মুসলিম, তাই এটা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে খুব আঘাত দিয়েছে। অন্যদের মতো আমিও উদ্বিগ্ন। আমার ছোট বোন বা কাজিনরা যখন আমাকে জিজ্ঞেস করে, তাদের কিছু হয়ে যাবে কি না, তখন আমি তাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করি। স্কুলে হিজাব পরা তরুণী মেয়েদের দেখি, যারা ভয়ে থাকে হামলার শিকার হওয়ার। সত্যিই, এটা খুব কঠিন।’
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: