স্মরণ: সাইফুল আজম

আকাশযুদ্ধে ইসরায়েলকে কুপোকাত করেছিলেন যে বাংলাদেশি 'ঈগল'

মুনা নিউজ ডেস্ক | ১১ জুলাই ২০২৫ ১৬:২২

ফাইল ছবি ফাইল ছবি

আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ চলছে, চারপাশে গর্জে উঠছে যুদ্ধবিমান আর গোলার শব্দ। ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান যখন একে একে ধ্বংস করছে আরব বাহিনীর বিমানঘাঁটি, তখন জর্ডান থেকে উড়ে আসা একজন পাইলট গুলি করে ভূপাতিত করেন ইসরায়েলের একটি যুদ্ধবিমান। এতেই হঠাৎ পাল্টে যায় দৃশ্যপট। সাইফুল আজম নামের ওই পাইলট ছিলেন এক গর্বিত বাংলাদেশি।

১৯৬৭ সালের ছয় দিনের সেই ভয়ংকর যুদ্ধে তিনটি ভিন্ন দেশের হয়ে যুদ্ধ করে চারটি ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেন সাইফুল আজম নামের ওই পাইলট। তখন তিনি ছিলেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর পাইলট, পরে স্বাধীন বাংলাদেশের বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। এই সাহসিকতা তাঁকে বানিয়েছে বিশ্ব ইতিহাসে এক অনন্য বাঙালি নায়ক।

১৯৬৭ সালের ৫ জুন। ওই দিন বিকেলে ইসরায়েলের চারটি যুদ্ধবিমান জর্ডানের মাফরাক বিমানঘাঁটিতে আক্রমণ করে। উদ্দেশ্য ছিল, ছোট্ট দেশটির বিমানবাহিনীকে শেষ করে দেওয়া। এর আগে তারা মিসরীয় বিমানবাহিনীকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। সেদিন মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে ইসরায়েলি বিমানবাহিনী মাটিতে থাকা দুই শতাধিক মিসরীয় যুদ্ধবিমান ধ্বংস করে দিয়েছিল।

কিন্তু জর্ডানের মাফরাক বিমানঘাঁটি ধ্বংস করার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই ইসরায়েলের একটা যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেন তৎকালীন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সাইফুল আজম। জর্ডান বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান ওড়ানোর সময় তিনি ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করেন।

এ ঘটনার দুই দিন পর ৭ জুন ইরাকের বিমানবাহিনীর একটা বিমান ওড়ানোর সময় ইসরায়েলের আরও দুটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেন তিনি। এ ছাড়া ১৯৬০ সালে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে কমিশন পাওয়া সাইফুল আজম ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ভারতীয় বিমানবাহিনীরও একটা বিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছিলেন।

পাকিস্তান থেকে জর্ডান

পাকিস্তানের ফ্লাইট লেফটেন্যান্টের পদে থাকাকালে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার পর সাইফুল আজমকে পাকিস্তান সরকার ‘সিতারা-ই-জুরাত’ সামরিক পদক দিয়ে সম্মানিত করে। এরপর ১৯৬৬ সালের শেষের দিকে সাইফুল আজম জর্ডান বিমানবাহিনীর উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে অংশ নেন তিনি। ওই যুদ্ধে একদিকে ছিল ইসরায়েল, অন্যদিকে জর্ডান, মিসর, সিরিয়া, ইরাকসহ আরব দেশগুলোর জোট।

ইতিহাসবিদ ও সাবেক এয়ার কমোডর কায়সার তুফায়েল তাঁর ‘গ্রেট এয়ার ব্যাটলস অব পাকিস্তান এয়ার ফোর্স’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে আকাশ প্রতিরক্ষার সীমিত অনুমতি পাওয়ার পর সাইফুল আজম জর্ডানের মাফরাক বিমানঘাঁটি থেকে লেফটেন্যান্ট এহসান শারদুমকে নিয়ে হান্টার বিমানে সওয়ার হয়ে উড়ান শুরু করেন। তাঁদের পেছনে পেছনে অন্যান্য হান্টার বিমানও উড়তে শুরু করে।’

ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ধ্বংস

কায়সার তুফায়েলের বর্ণনায় জানা যায়, মরুভূমির ধুলা আর উত্তাপে চারদিক ঝাপসা। এক মাইলের কম দৃষ্টিসীমা। রাডারে শত্রু আসার সংকেত পেতেই মাফরাকের পথে উড়ে যান সাইফুল আজম। মাফরাক থেকে মাত্র চার মাইল দূরে কম উচ্চতায় ওড়া চারটি যুদ্ধবিমানকে ইসরায়েলি মিস্টেয়ার বলে অনুমান করেন সাইফুল। সঙ্গে সঙ্গে একটির পিছু নিয়ে শক্তিশালী বন্দুক দিয়ে গুলি ছোড়েন সাইফুল। মিস্টেয়ারটিতে আগুন ধরে ভেঙে পড়ে সীমান্তের কাছে। তবে যুদ্ধবিমানটির পাইলট লেফটেন্যান্ট হানানিয়া বের হতে পারেননি।

এরপর এহসান শারদুমকে একটি শত্রু বিমান নিশানা করতে বলেন সাইফুল, আর নিজে ধাওয়া করেন বাকি দুই মিস্টেয়ারকে। শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্তে উড়তে থাকে চতুর্থ বিমানটিও। চারবার গুলি করে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পঞ্চম গুলিতে লাগে নিশানা, মিস্টেয়ারটি কাত হয়ে পড়ে যায়।

আরেকটি ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান এবার সাইফুলকে লক্ষ্য করে ঘুরছে। জ্বালানি আর গুলির স্বল্পতায় পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। রেডিও বার্তায় অবতরণের অনুমতি পেলেও এহসান কোড চেয়ে ফাঁদ বুঝে যান। জর্ডান থেকে সতর্কবার্তা আসে: রানওয়েটি আসলে একটি ফাঁদ। সিদ্ধান্ত বদলে সবাই রওনা হন আম্মান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দিকে। সেখানেই নিরাপদ অবতরণ করেন ইসরায়েলি হামলার ঠিক আগমুহূর্তে।

কায়সার তুফায়েল তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ইসরায়েলি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় আম্মানের বিমানবন্দরের সিভিল সেন্টারসহ বহু স্থাপনা। ধ্বংস হয় একাধিক উড়োজাহাজ ও হেলিকপ্টার। এর ঘণ্টাখানেক পর অপারেশন হেডকোয়ার্টারে উপস্থিত হন জর্ডানের বাদশাহ হুসেইন। তিনি নিজে এসে প্রশংসা করেন যুদ্ধরত পাইলটদের। জর্ডান সরকার পাইলটদের ইরাকের পক্ষে যুদ্ধ করার প্রস্তাব দেয়। দ্রুত পাঠানো হয় নতুন মিশনে, হাবানিয়া বিমানঘাঁটির উদ্দেশে।

মরুর বুকে এইচ-থ্রি অভিযান

৬ জুন রাত ৯টায় জর্ডান থেকে যাত্রা করে পাইলটদের যুদ্ধের সরঞ্জাম পৌঁছায় ইরাকের হাবানিয়া ঘাঁটিতে। সেখানে ছিল তিনটি হান্টার স্কোয়াড্রন। ৭ জুন সকালে ঘুম ভাঙে সাইফুলের। ইরাকি বেজ কমান্ডারের পক্ষ থেকে তাঁর কাছে বার্তা আসে, ‘প্রথম ফ্লাইটের নেতৃত্ব আপনি দেবেন।’

এর কিছুক্ষণ পরই ইরাকের পশ্চিমাঞ্চলের প্রত্যন্ত মরুভূমিতে অবস্থিত এইচ-থ্রি ঘাঁটির দিকে রওনা দেয় চারটি হান্টার বিমান। ২৫ হাজার ফুট ওপরে উড়তে থাকা অবস্থায় ঘোষণা আসে, এইচ-থ্রিতে হামলা করা হচ্ছে, নিচে গিয়ে প্রতিরোধ করুন।

কায়সার তুফায়েল তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ইসরায়েলি বিমানের ফরমেশনে ছিলেন ডেপুটি স্কোয়াড্রন কমান্ডার ক্যাপ্টেন সোলেমন করণ এবং আরও পাঁচ অভিজ্ঞ পাইলট। পশ্চিম দিক থেকে আসা মিরাজ বিমান দেখে ফরমেশন ভাগ করেন সাইফুল, প্রতিরোধে নামেন তিনি ও এহসান। দূরত্ব কমিয়ে মিরাজকে লক্ষ্য করেন সাইফুল। গুলির আঘাতে ডানায় আগুন লেগে আকাশেই ভস্মীভূত হয় শত্রুপক্ষের ওই বিমান।

মিরাজ ধ্বংস করার পর সাইফুল ডান দিকে মোড় নিয়ে দেখেন প্রায় দুই হাজার ফুট নিচে দিয়ে যাচ্ছে আরেকটা শত্রু বিমান। দ্বিতীয় শত্রু বিমানকে ধাওয়া করতে গিয়ে স্প্লিট-এস মুভমেন্ট করতে থাকেন তিনি। মাটি থেকে কম উচ্চতায় এই মুভমেন্ট বিপজ্জনক। এ কারণে প্রচণ্ড চাপে অচেতন হয়ে গিয়েছিলেন সাইফুল।

চেতনা ফিরে পেয়ে দেখেন থ্রটল বন্ধ ও ব্রেক খোলা। এই অবস্থায় নিশানায় আঘাত করেন সাইফুল। এতে শত্রুপক্ষের বিমান আকাশে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। তবে শত্রুপক্ষের ওই বিমানের দুই পাইলট ডারভার ও গোলান প্যারাসুটে করে প্রাণে বেঁচে যান।

সব বিমানের জ্বালানি প্রায় ফুরিয়ে গিয়েছিল। কারণ, তাঁরা বিমান থেকে অতিরিক্ত ট্যাংক ফেলে দিয়েছিলেন। এরপর সাইফুল ও এহসান ফিরে আসেন হাবানিয়া ঘাঁটিতে, উঁচু উড়ান আর নিখুঁত নিয়ন্ত্রণে। বিমান থেকে নামার পরই সাইফুল আজমকে নিয়ে লোকজন উদ্‌যাপনে মেতে ওঠেন। সাইফুলের চোখে তখন আনন্দাশ্রু।

ইসরায়েলি বিমানবাহিনী অসংখ্য সাফল্য অর্জন করলেও এইচ-থ্রি অভিযানের পর তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। এই অভিযানে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয় তারা। এই অভিযানে ইসরায়েলের তিনটি বিমান ধ্বংস, দুই পাইলট নিহত বা আটক হন।

‘বেস্ট ডিফেন্স অব ইসরায়েল’ বইয়ে কর্নেল এলিয়াজার কোহেন লিখেছেন, ‘এইচ-থ্রির সামান্য ক্ষয়ক্ষতি হলেও আমাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল বিশাল। একজন পাইলট ও নেভিগেটরের মৃত্যু হয়েছিল, দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং তিনটি বিমান ধ্বংস হয়েছিল।’

তিন দেশের পক্ষ থেকে সাইফুলকে সম্মাননা

এরপর জর্ডান, ইরাক ও পাকিস্তান তিন দেশই সাইফুল আজমকে সামরিক পদকে সম্মানিত করে। জর্ডান সরকার সাইফুল আজমকে ‘উইসাম আল-ইসতিকলাল’, ইরাক ‘নুত আল-সুজাত’ এবং পাকিস্তান ‘সিতারা-ই-বাসালাত’ পদক দিয়ে সম্মানিত করে। এর আগে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে একটা ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করার পর তাঁকে ‘সিতারা-ই-জুরাত’ পদক দেওয়া হয়েছিল।

এরপর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ফিরে সাইফুল আজম বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। ২০০১ সালে ‘লিভিং ইগল’ হিসেবে তাঁর নাম ইন্টারন্যাশনাল হল অব ফেম-এর অন্তর্ভুক্ত হয়। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সাময়িকী ‘সেকেন্ড টু নান’-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে এয়ার কমোডর মোহাম্মদ আলী লিখেছেন, ‘সাইফুল আজম চারটি দেশের (পাকিস্তান, জর্ডান, ইরাক ও বাংলাদেশ) বিমানবাহিনীতে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং দুই দেশের (ভারত ও ইসরায়েল) বিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছেন।’

অবসরের পর বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে পাবনা থেকে অংশ নিয়ে সাইফুল সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের সামরিক কর্মকর্তা ও বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার শহীদুল ইনাম খান তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন, সাইফুল আজমের সাহসিকতা ইসরায়েলেও প্রশংসিত হয়। ২০২০ সালের জুনে তাঁর মৃত্যুর পর সংবাদপত্রগুলো সাইফুল আজমের বিষয়ে বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশ করেছিল।

শহীদুল ইনাম খান লিখেছিলেন, ‘১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে যখন একটা ইসরায়েলি বিমানকে নিশানা করেছিলেন সাইফুল, তখন সরাসরি আক্রমণ করার বদলে পাশ থেকে নিশানা করেন এবং বিমানের লেজে গুলি করেন। ইসরায়েলি পাইলট প্রাণে বেঁচে যান। প্যারাসুটের সাহায্যে অবতরণ করেন তিনি।’

শহীদুল ইনাম খান আরও লিখেছেন, ‘পাইলট পরে জানান, তিনি যখন নিচে নামছিলেন, তখন সাইফুল রোল অ্যান্ড লুপ দিয়ে তাঁর দিকে হাত নাড়েন। এরপর তিনি আরেকটা ইসরায়েলি বিমানকে গুলি করে ভূপাতিত করার জন্য ধেয়ে যান। সাইফুল না চাইলে ওই পাইলট বাঁচতেন না।’

জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ছয় দিনের যুদ্ধ শেষ হয়, কিন্তু তত দিনে ইসরায়েল গোলান মালভূমি, গাজা, সিনাই উপদ্বীপ ও পশ্চিম তীর (পূর্ব জেরুজালেমসহ) দখল করে নেয় এবং মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র পুরোপুরি বদলে দেয়। তবে এই যুদ্ধ সাইফুল আজমের কীর্তির জন্য আজও স্মরণীয় হয়ে আছে।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: