
ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া শত শত কোটি ডলারের সরকারি ভর্তুকি বন্ধের হুমকি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিশ্বের শীর্ষ ধনী মাস্কের সঙ্গে দীর্ঘদিনের টানাপোড়েনের মাত্রা বাড়িয়ে গতকাল মঙ্গলবার এমন পদক্ষেপ গ্রহণের হুমকি দিলেন প্রেসিডেন্ট। একসময় একে-অপরের ঘনিষ্ঠ মিত্র থাকলেও বর্তমানে তাঁরা মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছেন।
গত সোমবার নতুন করে শুরু হয় ট্রাম্প ও মাস্কের এ দ্বন্দ্ব। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে বিপুল অর্থ ব্যয় করলেও পরে মাস্ক তাঁর কর হ্রাস ও সরকারি ব্যয় বাড়ানোর বিল নিয়ে সমালোচনা করেন। বিলটি কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটে মাত্র এক ভোটের ব্যবধানে (৫১-৫০) পাস হয়। এ বিলের ফলে বৈদ্যুতিক গাড়ি (ইভি) কেনায় যে ভর্তুকি পাওয়া যায়, তা উঠে যেতে পারে। এ ভর্তুকিতে মূলত টেসলার মতো মাস্কের প্রতিষ্ঠানগুলো উপকৃত হতো।
মাস্ক অনেকবার সরকারি ভর্তুকির বিরোধিতা করলেও পরিবেশবান্ধব গাড়ি এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে কাজ করার সুবাদে টেসলা বছরের পর বছর ধরে শত শত কোটি ডলারের করছাড় ও সরকারি সুবিধা পেয়ে আসছে। এসব কর্মসূচির অনেকগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আছে ট্রাম্প প্রশাসনের। ইভি কেনা বা লিজ নেওয়ার ক্ষেত্রে ৭ হাজার ৫০০ ডলারের ভোক্তা করছাড়ও এমন একটি জনপ্রিয় কর্মসূচি, যা সিনেটে পাস হওয়া নতুন কর বিলের আওতায় পড়েছে।
একই দিন মাস্ক তাঁর নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পরিকল্পনা থাকার কথা ঘোষণা দেন এবং যেসব আইনপ্রণেতা ওই কর বিলকে সমর্থন দিয়েছেন, তাঁদের নির্বাচনে হারাতে তিনি অর্থ ব্যয় করবেন বলে জানান। অথচ মাস্ক নিজেই বরাবর সরকারি ব্যয় কমানোর পক্ষে প্রচার চালিয়েছেন।
রিপাবলিকানরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, ট্রাম্প ও মাস্কের এ দ্বন্দ্ব ২০২৬ সালে কংগ্রেসের মধ্যবর্তী নির্বাচনে দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখার ক্ষেত্রে ক্ষতি করতে পারে। এ বিল সরকারের ঘাটতি বাড়াবে-মাস্কের এমন সমালোচনার জবাবে অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট বলেন, ‘দেশের আর্থিক বিষয় আমি দেখছি।’
ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় কমাতে গঠন করেন ‘ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিশিয়েন্সি’ বা ডিওজিই নামের নতুন বিভাগ। গত মে মাসের শেষ দিকে মাস্ক এটির নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ান।
মঙ্গলবার ট্রাম্প তাঁর নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে লেখেন, ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ভর্তুকি পেয়েছেন সম্ভবত ইলন মাস্ক। আর রকেট উৎক্ষেপণ, স্যাটেলাইট, বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদন- সব বন্ধ হলে যুক্তরাষ্ট্র প্রচুর টাকা বাঁচাবে। পরে সাংবাদিকদের উদ্দেশে হেসে ট্রাম্প বলেন, ডিওজিই হলো সেই দানব, যা হয়তো ফিরে গিয়ে ইলনকেই খেয়ে ফেলতে পারে।
ট্রাম্পের এমন হুমকির জবাবে মাস্ক তাঁর প্ল্যাটফর্ম এক্সে লেখেন, ‘আমি নিজেই বলছি, সব ভর্তুকি বন্ধ করে দাও। এখনই।’ পরে লেখেন, ‘আমি চাইলে আরও কড়া জবাব দিতে পারি, কিন্তু আপাতত সংযত থাকছি।’
ট্রাম্পের সঙ্গে দ্বন্দ্বের ফলে মাস্কের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে টেসলার জন্য। এটি তাঁর সম্পদের মূল উৎস। সংস্থাটি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের অস্টিনে স্বচালিত রোবোট্যাক্সি চালুর পরীক্ষামূলক প্রকল্প চালাচ্ছে। তবে এ ধরনের গাড়ি বাণিজ্যিকভাবে চালু করার ক্ষেত্রে অঙ্গরাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়মনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
‘টেসলার বর্তমান বাজারমূল্য মূলত তাদের স্বচালিত গাড়ি প্রযুক্তির অগ্রগতির ওপর নির্ভর করছে। এ খাতে বড় কোনো অগ্রগতি না–ও হতে পারে, তবে এটাই এখন সবচেয়ে বড় ঝুঁকি’, বলেছেন টেসলায় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ডিপওয়াটার অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থাপনা অংশীদার জিন মানস্টার।
বুধবার টেসলার দ্বিতীয় প্রান্তিকের বিক্রির তথ্য প্রকাশ হবে। বিশ্লেষকেরা পূর্বাভাস দিয়েছেন, এবারও দুর্বল ফল আসতে পারে। গতকাল প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, ইউরোপের প্রধান বাজারে টেসলার গাড়ি বিক্রিতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, মাস্কের কট্টর ডানপন্থী রাজনৈতিক অবস্থান বিশ্ববাজারে টেসলার ক্রেতাদের দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।
এ ছাড়া করছাড় বাতিল হলে ২০২৪ সালের টেসলার পরিচালন আয় থেকে প্রায় ১ দশমিক ২ বিলিয়ন (১২০ কোটি) ডলার, অর্থাৎ ১৭ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে- এমনটা পূর্বাভাস দিয়েছে জেপি মরগান। সিনেটে পাস হওয়া বিলে পরিবর্তন আনতে গতকাল প্রতিনিধি পরিষদকে অনুরোধ করেছে বৈদ্যুতিক গাড়ি খাতে কাজ করা সংগঠন ‘ইলেকট্রিফিকেশন কোয়ালিশন’। এদিন ছোট ইভি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রিভিয়ান ও লুসিড গ্রুপের শেয়ারের দাম কমেছে যথাক্রমে ২ শতাংশ ও ৩ দশমিক ৮ শতাংশ।
দীর্ঘদিনের টেসলা বিনিয়োগকারী গ্যারি ব্ল্যাক সম্প্রতি শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। গাড়ি বিক্রি কমায় তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানান। তিনি রয়টার্সকে বলেন, আবারও বিনিয়োগের সময় নিয়ে ভাবছেন, তবে করছাড় বন্ধ হলে টেসলা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এক্স-এ পৃথক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘@elonmusk কেন বুঝলেন না, ট্রাম্পের বিগ বিউটিফুল বিল পাসে বাধা দেওয়ার ফলে এমন ফল আসবে?’
যুক্তরাষ্ট্রের পরিবহন দপ্তর দেশটিতে গাড়ির নকশা অনুমোদন করে থাকে। এখন টেসলা পেডেল ও স্টিয়ারিং হুইল ছাড়া গণহারে রোবোট্যাক্সি তৈরি করতে পারবে কি না- পরিবহন দপ্তর এ সিদ্ধান্ত গ্রহণে বড় ভূমিকা রাখবে। অন্যদিকে মাস্কের রকেট কোম্পানি স্পেসএক্স ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে রয়েছে।
গত মাসের শুরুতে ট্রাম্প প্রথম মাস্কের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ান। তখনই তিনি ইঙ্গিত দেন, মাস্কের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সরকারি চুক্তি বাতিল করা হতে পারে। ওই সময় কর বিল নিয়ে তাঁদের মধ্যে তুমুল বিতণ্ডা হয় সামাজিক মাধ্যমে। বিলটি নিয়ে নিরপেক্ষ বিশ্লেষকেরা বলছেন, এতে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ তিন ট্রিলিয়ন (তিন লাখ কোটি) ডলার বাড়তে পারে।
পরিশেষে হোয়াইট হাউস ছাড়ার সময় সাংবাদিকেরা ট্রাম্পকে প্রশ্ন করেন- তিনি কি মাস্ককে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করতে চান? উত্তরে ট্রাম্প বলেন, ‘জানি না। দেখা যাক।’
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: