স্টেট ডিপার্টমেন্টের রিপোর্ট

বাংলাদেশে গত সরকারের শেষ সময়েও বিরোধী ও ভিন্নমতাবলম্বীরা গুম, অপহরণ ও আটকের শিকার ছিলো

মুনা নিউজ ডেস্ক | ১৩ আগস্ট ২০২৫ ১৬:১১

ছবি : সংগৃহীত ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশে পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সরকারি কর্তৃপক্ষ বা তাদের পক্ষ থেকে জোরপূর্বক গুমের ঘটনা ঘটেছে। নিরাপত্তা সংস্থার সদস্যরা গুম ও অপহরণে অব্যাহতভাবে জড়িত ছিলেন। জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস)-এর তথ্য অনুযায়ী, তিনজন জোরপূর্বক গুমের শিকার হয়েছেন।

এ ছাড়া আটজনকে অবৈধভাবে ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় আটক রেখে পরে মুক্ত বা গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পূর্ববর্তী সরকার এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধ, তদন্ত বা শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে সীমিত উদ্যোগ নিয়েছে। নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলো জানিয়েছে, গুমের বেশির ভাগ ভুক্তভোগীই রাজনৈতিক বিরোধী দলের নেতা, কর্মী ও ভিন্নমতাবলম্বী।

গুমের পর নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী কিছু ব্যক্তিকে বিনা অভিযোগে মুক্তি দিয়েছে। অন্যদের গ্রেপ্তার করেছে। অনেককে রাখা হয় গোপন কারাগারে। স্থানীয়ভাবে তা আয়নাঘর হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশে ২০২৪ সালে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক মানবাধিকার বিষয়ক রিপোর্টে জোরপূর্বক গুম প্রসঙ্গে এসব কথা বলা হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে জোরপূর্বক একটি গুমের অভিযোগ পাওয়া গেছে। আসলাম সেরনিয়াবাত নামে এক অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তার স্বজনরা অভিযোগে বলেন, ২৯শে আগস্ট ঢাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ইউনিফর্ম পরা সদস্য ও সাদাপোশাকধারীরা মিলে তাকে অপহরণ করে। ২৫শে সেপ্টেম্বর পুলিশ তাকে একটি হত্যা মামলার আসামি হিসেবে আদালতে হাজির করে। সরকার পরিবর্তনের পরপরই বহু গুমের শিকার ব্যক্তিকে গোপন বন্দিশাল থেকে মুক্তি দেয়া হয়। সেখানে কেউ কেউ টানা আট বছর পর্যন্ত আটক ছিলেন।

পাঁচ বছরেরও বেশি সময় গোপন আটক থাকার পর মুক্তি পান পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী ও অধিকারকর্মী মাইকেল চাকমা। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের হিসাবে আরও প্রায় ১০০ জন জোরপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তি এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। ফ্রিডম হাউসের ফ্রিডম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ২০২৪ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দীর্ঘদিন ধরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, অপহরণ এবং অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এর মধ্যে মাদক ব্যবসা, সংগঠিত অপরাধ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অভিযানও অন্তর্ভুক্ত।’

আগস্ট মাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ‘বাংলাদেশ কমিশন অন এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স’ গঠন করে। এর দায়িত্ব ছিল ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত জোরপূর্বক গুমের ঘটনা তদন্ত করা। প্রথমে কমিশনকে ৪৫ দিনের জন্য দায়িত্ব দেয়া হলেও পরে তদন্ত সম্পূর্ণ করার জন্য অতিরিক্ত সময় দেয়া হয়। নভেম্বরের শুরুতে কমিশন ঢাকার ভেতরে ও আশপাশে আটটি গোপন বন্দিশিবির সনাক্ত করে এবং ১৬০০টি জোরপূর্বক গুমের অভিযোগ গ্রহণ করে।

বাংলাদেশের সংবিধান ইচ্ছাকৃতভাবে গ্রেপ্তার ও আটক নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু আইন অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যক্তিকে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার ও আটক করতে পারে যদি তারা মনে করে যে, ওই ব্যক্তি নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি হতে পারেন, অথবা গুরুতর অপরাধে জড়িত থাকতে পারেন। প্রায়শই কর্তৃপক্ষ আটক ব্যক্তিদের কয়েক দিন গোপনে রাখত। পরিবারের সদস্য বা আইনজীবীদের কাছে তাদের অবস্থান বা পরিস্থিতি প্রকাশ করা হতো না। এমনকি গ্রেপ্তারের বিষয়টি স্বীকারও করত না। সংবিধানে যে কোনো ব্যক্তির আদালতে তার গ্রেপ্তার বা আটকের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করার অধিকার আছে। পূর্ববর্তী সরকার সাধারণত এই সাংবিধানিক শর্ত মানেনি। তবে নভেম্বর থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই বিধান মেনে চলা শুরু করে।

সংবিধান অনুযায়ী গ্রেপ্তার ও আটক অবশ্যই ওয়ারেন্টের মাধ্যমে বা অপরাধ সংঘটিত হতে দেখা গেলে হতে হবে। তবে আইনে এই সুরক্ষাগুলোর ব্যাপক ব্যতিক্রম অনুমোদিত। সংবিধান অনুযায়ী, আটক ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিচারিক কর্মকর্তার সামনে হাজির করে অভিযোগ গঠন করতে হবে। কিন্তু এটি নিয়মিতভাবে কার্যকর করা হয়নি। সরকার বা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ কোনো কর্মকাণ্ড প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে কাউকে ৩০ দিনের জন্য আটক করার নির্দেশ দিতে পারেন। তবে কর্তৃপক্ষ প্রায়ই নির্বিঘ্নে আরও দীর্ঘ সময় ধরে আটক রেখেছে। দেশে কার্যকর জামিন ব্যবস্থা থাকলেও, পুলিশ নিয়মিতভাবে জামিনপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে অন্য মামলায় পুনরায় গ্রেপ্তার করেছে। যদিও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ নতুন মামলায় কাউকে আদালতে হাজির না করেই পুনরায় গ্রেপ্তারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

সাধারণত কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে আদালতে অভিযোগ গঠনের পরেই আসামির আইনজীবীদের তাদের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি দিত, যা কিছু ক্ষেত্রে প্রাথমিক গ্রেপ্তারের কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস পর ঘটত। আটক ব্যক্তিরা আইনগতভাবে আইনজীবীর সাহায্য পাওয়ার অধিকারী ছিলেন, এমনকি তারা যদি এর খরচ বহন করতে না পারেন তবুও। কিন্তু এই সেবা দেওয়ার জন্য দেশে পর্যাপ্ত তহবিল ছিল না। রিপোর্টে আরও বলা হয়, বহু আটক ব্যক্তিকে বন্দিদশার বাইরে অন্য কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেয়া হতো না। রাজনৈতিক সভাসমাবেশ বা বক্তব্য, কথিত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অংশ হিসেবে মাঝে মাঝেই খেয়ালখুশিমতো গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া সরকার বিভিন্ন ব্যক্তিকে আটক রেখেছে। কখনো কখনো অন্য সন্দেহজনক ব্যক্তি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য এসব আটক করা হতো।

মানবাধিকার বিষয়ক কর্মীরা বলেন, পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে থাকা পুলিশ বাহিনী বিরোধী দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের টার্গেট করে মিথ্যা মামলা করতো। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনপীড়ন করতে আইন প্রয়োগকারী এজেন্সিকে ব্যবহার করতো সরকার। পূর্ববর্তী সরকারের অধীনে বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যদের অব্যাহতভাবে খেয়ালখুশিমতো গ্রেপ্তার করতে থাকে। জানুয়ারিতে বিরোধী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির সদস্যদের অভিযোগ নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করে। তারা বলেন, জানুয়ারির নির্বাচনকে সামনে রেখে পূর্ববর্তী সরকার বিএনপির সমর্থক ও বিরোধী রাজনীতিকেরকে বানোয়াট অভিযোগে বড় আকারে দমনপীড়ন চালাচ্ছে। তারা দাবি করেন, নির্বাচনের কয়েক মাস আগে থেকেই বিএনপির কমপক্ষে ২০ হাজার সদস্যকে জেলে রাখা হয়েছে। তবে ওই সরকারের কর্মকর্তারা দাবি করেন এই সংখ্যা অনেক কম। রাজনৈতিক উদ্দেশে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে অগ্নিসংযোগের মতো সুনির্দিষ্ট ক্রিমিনাল অভিযোগে। বিচার কার্যক্রম শুরুর আগে নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা না মেনে সাজানো আটকের ঘটনা চলতেই থাকে।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: