ফাইল ছবি
                                    ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সাড়ে ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদ শাসনের যবনিকা টানতে হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশেও শুরু হয় বৈদেশিক প্রভাবের পালাবদল। হাসিনা সরকার ক্ষমতার পুরো সময়ই নির্ভরশীল ছিল ভারতের ওপর। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই নির্ভরশীলতার নতুন ঠিকানা ওয়াশিংটন।
গণআন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন ছাত্র-জনতা হত্যার আদেশদাতা শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারত থেকে চরম পর্যায়ে বাংলাদেশ বিরোধিতা আসছে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে ভারত থেকে কখনোই বাংলাদেশ নিয়ে এত বিরোধিতা হয়নি। এ ছাড়া শেখ হাসিনাকে যেখানে কোনো দেশ আশ্রয় দিতে রাজি হচ্ছে না, সেখানে তাঁকে সম্পূর্ণ সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছে দিল্লি। সেই সঙ্গে ভারতে বসে শেখ হাসিনার একের পর এক ফোনালাপ ও বিবৃতি ঢাকা-দিল্লির সম্পর্কে চিড় ধরাতে পারে বলে সতর্কও করে দিয়েছে বাংলাদেশ। তারপরও শেখ হাসিনার তৎপরতা থেমে নেই। একদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়মিত করার কথা বললেও ভারত থেকে যেসব কার্যকলাপ চলছে, তাতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের চেয়ে শেখ হাসিনা দিল্লির কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এমন বার্তাই পাচ্ছে ঢাকা।
আর বিপরীত চিত্র ফুটে উঠেছে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কের ক্ষেত্রে। হাসিনা সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে সবচেয়ে বৈরী সম্পর্ক ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক তৎকালীন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি নিশা দেশাই বিসওয়ালের কাছে ঢাকার তখনকার রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাকে ‘বিএনপির বন্ধু’ বলে নালিশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। সেই থেকে সম্পর্ক ক্রমেই খারাপের দিকে গেছে। ঢাকায় দায়িত্বে আসা একাধিক রাষ্ট্রদূতকে হামলা ও হেনস্তার ঘটনাও ঘটেছে। আর ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগের পুরো বছর সরকারপ্রধান নিজেই একাধিক বক্তব্যে িদের সেন্টমার্টিনের দখল নিতে চাওয়া ও ষড়যন্ত্রের কথা বলেছেন। হাসিনা সরকার যাতে ক্ষমতায় টিকে থাকতে না পারে, যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে সব চেষ্টাই করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ আনা হয়েছিল। এমনকি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ভেতরে বিএনপি-জামায়াত বাদে পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের কথাও বলা হয়েছিল হাসিনা সরকারের পক্ষ থেকে। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হাসিনা সরকারের টানাপোড়েনের অন্যতম কারণ ছিল অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
তবে ৫ আগস্টের পর ঢাকা-ওয়াশিংটনের সম্পর্কের সেই পরিস্থিতি বদলে গেছে। ড. ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর সব ধরনের সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির অর্থ দপ্তরের সহকারী আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যানের নেতৃত্বে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা ঢাকায় সফরও করে গেছেন। হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের প্রতি ওয়াশিংটনের ভূরাজনৈতিক সমর্থন বিশ্বকে বোঝানো এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে সহযোগিতার ঝুলি নিয়ে এগিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র।
অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কোন দেশের সম্পর্ক সবচেয়ে উষ্ণ এবং কোন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক সবচেয়ে শীতল– জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সম্প্রতি বলেছেন, ‘বিগত সরকারের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটু টানাপোড়েন হয়েছিল। আমি মনে করি, সে জিনিসটি কেটে গেছে। আমাদের একটি নীতি রয়েছে, সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে চাই। সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় টানাপোড়েন ছিল এ নীতির ব্যত্যয়, সেটাকে আমরা সঠিক করতে পেরেছি।’
ভারত ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে বিশ্বের আর কোনো দেশ থেকে তেমন বিরোধিতা আসেনি। ইতোমধ্যে এ সরকারের সঙ্গে কাজ করতে এবং প্রয়োজনীয় সংস্কারে সহযোগিতা করতে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), চীন, রাশিয়া, জাপান, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশগুলো। বিশ্লেষকদের মতে, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ায় বিশ্বের এ সমর্থন পাওয়া গেছে।
কূটনীতিতে বর্তমান সরকারের দৃশ্যমান অর্জনের মধ্যে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) ৫৭ বাংলাদেশির সাজা মওকুফ, উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দলের সফর, জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ভলকার তুর্কের ঢাকা সফর এবং মালয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট আনোয়ার ইব্রাহিমের দ্বিপক্ষীয় সফরে ঢাকা ঘুরে যাওয়া। এ ছাড়া সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকের সাইড লাইনে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ বিশ্বনেতাদের সঙ্গে ড. ইউনূসের বৈঠক।
আর ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসা, বিভিন্ন দেশের ভিসা কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে স্বাভাবিক অবস্থানে নিয়ে আসা, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ, অর্থনৈতিক বিস্ময়ে যে গতি ছিল তা ধরে রাখা, প্রয়োজনীয় সংস্কার ও বিগত সরকারের আমলে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনা, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হত্যাকারীদের বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরত আনা অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, বাংলাদেশের কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ সিংহভাগ দূর হয়ে যাবে যদি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ হয়।
            
                                                        
                                                        
                                                        
                                                        
                                                        
                                                        
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: